আশুরা কি?
বছরের অনেক দিনকে আল্লাহ রব্বুল আলামীন নির্ধারণ করেছেন ইবাদত-বন্দেগী বা নেক আমল করার জন্য। এমনি একটা দিবসের নাম আশুরা। হিজরী সনের প্রথম মাস মুহাররমের দশ তারিখ। আল্লাহর নবী মুসা আলাইহিস্সালাম ফিরআউন ও তার বাহিনীর উপর বিজয় লাভ করেছিল। তাই এই দিনটি হচ্ছে শিরকের উপর তাওহীদের বিজয়ের দিন, তাগুতের উপর রিসালাতের পতাকাবাহীদের বিজয়ের সময়। এ দিনটি মুহাররমের দশ তারিখ হওয়ার কারণে এর নামকরণ করা হয় আশুরা।
২. কুরআনে আশুরা
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ.
নিশ্চয় মাসসমূহের গণনা আল্লাহর কাছে বার মাস আল্লাহর কিতাবে, (সেদিন থেকে) যেদিন তিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্য থেকে চারটি সম্মানিত মাস, এটাই প্রতিষ্ঠিত দীন। সুতরাং তোমরা এ মাসসমূহে নিজেদের উপর কোন যুল্ম করো না। (সূরা তাওবা: ৩৬ )
এ আয়াতে মুহাররম মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ মাসটি আসমান ও জমীন সৃষ্টির দিন থেকে পবিত্র, নিষিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ।
৩. হাদীসে নববীতে আশুরা
عن ابن عباس رضي الله عنهما قال: قدم النبي – صلى الله عليه وسلم – المدينة فرأى اليهود تصوم يوم عاشوراء فقال: مَا هَذَا قَالُوا هَذَا يَوْمٌ صَالِحٌ، هَذَا يَوْمٌ نَجَّى اللَّهُ بَنِي إِسْرَائِيلَ مِنْ عَدُوِّهِمْ فَصَامَهُ مُوسَى، قال: فَأَنَا أَحَقُّ بِمُوسَى مِنْكُمْ فَصَامَهُ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ رواه البخاري
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় আগমন করে দেখতে পেলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। নবীজী বললেন, এটি কি? তারা বলল, এটি একটি ভাল দিন। এ দিনে আল্লাহ তা‘আলা বনি ইসরাইলকে তাদের দুশমনের কবল থেকে রক্ষা করেছেন। তাই মুসা আলাইহিস্সালাম রোজা পালন করেছেন। রাসূলুল্লাহ বললেন, মুসাকে অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। অত:পর তিনি রোজা রেখেছেন এবং রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। (বুখারী: ১৮৬৫)
৪. মুহাররম মাসের গুরুত্ব ও ফযিলত
ক. মুহাররম নিষিদ্ধ ও পবিত্র মাস
খ. এ মাসকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাহরুল্লাহ বা আল্লাহ তা‘আলার মাস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যা এ মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদা বহন করে।
গ. মুহররম মাসে অধিক পরিমাণে নফল সিয়াম পালন করা
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللّهُ عنه قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللّهِ صلى الله عليه وسلم: “أَفْضَلُ الصّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللّهِ الْمُحَرّمُ. وَأَفْضَلُ الصّلاَةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلاَةُ اللّيْلِ”.
অর্থাৎ, রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহররম (মাসের রোজা)। (সহিহ মুসলিম,১৯৮২)
শা’বান মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিক সিয়াম পালন করেছেন বলে একাধিক সূত্রে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু মুহাররম মাসে অধিক পরিমাণে সিয়াম পালন করার বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আলমের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়নি। হতে পারে মুহাররম মাসের ফজিলত সম্পর্কে তাঁকে একেবারে জীবনের শেষ পর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে। আর তিনি তা বাস্তবায়ন করে যাবার সময় পাননি। (ইমাম নববি, শারহু সহিহ মুসলিম)
৫. আশুরার গুরুত্ব ও ফযিলত
ক. এই দিন সিয়াম পালনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অতিব আগ্রহী ছিলেন:
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
مَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَتَحَرَّى صِيَامَ يَوْمٍ فَضَّلَهُ عَلَى غَيْرِهِ إِلّا هَذَا الْيَوْمَ يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَهَذَا الشَّهْرَ يَعْنِي شَهْرَ رَمَضَانَ
আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রোজা রাখার জন্য এত অধিক আগ্রহী হতে দেখিনি যত দেখেছি এই আশুরার দিন এবং এই মাস অর্থাৎ রমজান মাসের রোজার প্রতি। (বুখারী: ১৮৬৭)
খ. এই দিনের সিয়াম বিগত বছরের কাফ্ফারা স্বরূপ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
صيام يوم عاشوراء، إني أحتسب على الله أن يكفر السنة التي قبله
আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, তিনি পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন। (মুসলিম: ১৯৭৬)
এটি আমাদের প্রতি মহান আল্লাহর অপার করুণা। তিনি একটি মাত্র দিনের রোজার মাধ্যমে পূর্ণ এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেন। সত্যই মহান আল্লাহ পরম মহিয়ান ও দয়াময়।
গ. জাহেলী সমাজও এদিনে সিয়াম পালন করত:
عن عائشة رضى الله عنها قالت : كانت قريش تصوم عاشوراء في الجاهلية وكان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصومه، فلما هاجر إلى المدينة صامه وأمر بصومه، فلما فرض شهر رمضان قال : من شاء صامه ومن شاء تركه رواه البخاري ومسلم
‘আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন জাহেলী যুগে কুরাইশরা আশুরার সওম পালন করত এবং রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সওম পালন করতেন। যখন তিনি মদীনায় হিজরত করলেন তখন তিনি এ সওম পালন করলেন ও অন্যদের পালন করতে আদেশ দিলেন। যখন রমজান মাসের সওম ফরজ হল তখন তিনি আশুরার সওম সম্পর্কে বললেনঃ “যার ইচ্ছা আশুরার সওম পালন করবে, আর যার ইচ্ছা ছেড়ে দিবে।” ( সহীহ মুসলিম: ১৪৬)
ঘ. এইদিন মুসা আলাইহিস্সালাম ও তার সম্প্রদায় সিয়াম পালন করেছেন
فَصَامَهُ مُوسَىَ شُكْراً. فَنَحْنُ نَصُومُهُ. فَقَالَ رَسُولُ اللّهِ صلى الله عليه وسلم: “فَنَحْنُ أَحَقّ وَأَوْلَىَ بِمُوسَىَ مِنْكُمْ” فَصَامَهُ رَسُولُ اللّهِ صلى الله عليه وسلم. وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ
অর্থঃ মুসা আলাইহিস্সালাম এই দিবসটি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করনার্থে সিয়াম পালন করেছেন তাই আমরাও এদিনে সিয়াম পালন করছি।… ( সহীহ মুসলিম: ১১৩০)
৫. আশুরার সওমের বিধান
আশুরার সওম পালন সুন্নাত। এটি ফরয বা ওয়াজিব নয় তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবীদেরকে এ সিয়াম সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি যারা এদিনে সিয়াম করেনি তাদেরকে দিনের বাকী অংশ সিয়াম পালনে বাধ্য করেছেন। বর্ণনায় এসেছে শিশুদেরকেও পানাহার থেকে বিরত রাখতে বলেছেন।
আশুরার সিয়ামের পর্যায় হচ্ছে চারটি।
প্রথমতঃ আশুরার আগে পরে দুইদিন ও আশুরাসহ তিনদিন সিয়াম পালন করা। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ এটিকে উত্তম বলেছেন। ইবনে আব্বাস রা. থেকে মওকুফ সহীহ সনদে এর সমর্থন পাওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে বর্ণিত মারফু হাদীসটি যাতে বলা হয়েছে
عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم : صُومُوا يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَخَالِفُوا فِيهِ الْيَهُودَ ، صُومُوا قَبْلَهُ يَوْمًا أَوْ بَعْدَهُ يَوْمًا
এই হাদীসটি সনদের দিক থেকে দূর্বল।
দ্বিতীয়তঃ নবম ও দশম তারিখ রোযা রাখা। এর স্বপক্ষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে সহীহ বর্ণনায় হাদীস পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ
عن عبد الله بن عباس رضى الله عنهما قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لئن بقيت إلى قابل لاصومن التاسع
অর্থঃ যদি আমি সামনের বছর বেচে থাকি তাহলে অবশ্যই মুহাররমের নয় তারিখে রোজা রাখব। (মুসলিম: ১৫১)
তৃতীয়তঃ দশম ও একাদশ দিবস সিয়াম পালন করা।
চতুর্থতঃ শুধু দশম দিবসে সিয়াম পালন করা। একদল ওলামা কেরাম শুধু আশুরা দিবসের সিয়াম পালনকে মাকরূহ বলেছেন। এ মতটিকে শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ সমর্থন করেছেন তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সকল বর্ণনায় সাব্যস্ত হয়েছে তিনি কেবল দশম তারিকে সিয়াম পালন করেছেন। সুতরাং কেবল দশম তারিখে সিয়াম পালন করা মাকরূহ এর শর‘য়ী কোন ভিত্তি নেই।
৬. আশুরা সম্পর্কিত প্রচলিত ভুল আক্বীদা – বিশ্বাস
ক. হুসাইন ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মৃত্যুতে এ দিনটিকে পবিত্র মনে করা
শিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন এই দিবসটিকে শুধুমাত্র হুসাইন ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু’র মৃত্যুর জন্যে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। আর শিয়াদের ব্যাপক প্রচারণার কারণে এবং ইসলাম বিষয়ে না জানার কারণে অনেক সাধারণ মুসলিমও এমন ধারণা পোষণ করে থাকেন। উদাহরণ স্বরূপ, আশুরা দিবস উপলক্ষে পত্রিকাগুলোতে যে বিশেষ ফিচার লেখা হয় সেখানে হুসাইন ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যু তথা কারবালার ঘটনাটিকেই বিশেষ গুরুত্ব সহকারে বর্ণনা করা হয়। এসব আলোচনা থেকে মনে হয় যেন কারবালার ঘটনার পর আশুরার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সাব্যস্ত হয়েছে। অথচ আশুরার তাৎপর্যের সাথে কারবালার ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই! কারণ, আশুরা সেই দিনটিকেই বলা হয় যেদিন তাওহীদ শির্কের উপর বিজয়ী হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এইদিনটির তাৎপর্য বর্ণনা করে গেছেন এবং এ দিবসে কি করণীয় তাও সাহাবীদের শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। অথচ হুসাইন ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যুর ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর! কাজেই হুসাইন ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যুর ঘটনা তথা কারবালার ঘটনাকে আশুরার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় মনে করা সহীহ ধারণার পরিপন্থী।
খ. এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, এ দিবসে সবকিছু সৃষ্টি ও বিবর্তন হয়েছে
এই দিবস সম্পর্কে অনেকেই বর্ণনা করে থাকেন যে, এই দিনটিতে পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এই দিনটিতেই ধ্বংস হবে। আদম আলাইহিস্সালামকে এই দিবসে সৃষ্টি করা হয়েছে, নূহ আলাইহিস্সালামের প্লাবন এই দিবসে হয়েছিল এবং এই দিনেই প্লাবন শেষে নৌকা জুদি পাহাড়ে ঠেকেছিল। এই দিনে মাছের পেট থেকে ইউনুস আলাইহিস্সালামকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল, মুসা আলাইহিস্সালাম এই দিনে তাওরাত লাভের জন্যে তুর পাহাড়ে গিয়েছিলেন, নমরুদের আগুন থেকে ইব্রাহিম আলাইহিস্সালামকেও এই দিনে মুক্তি দেয়া হয়েছিল, এদিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে প্রভৃতি ঘটনা আমাদের মাঝে প্রচলিত রয়েছে। অথচ এসবের কোন সঠিক ও বিশুদ্ধ প্রমাণ পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে বর্ণিত হাদীস সমূহ অত্যন্ত দূর্বল ও বানোয়াট।
গ. এ দিনে মিরাজ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম হয়েছে মনে করা
কেউ কেউ বর্ণনা করে থাকেন এই দিবসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিরাজ হয়েছে এবং তিনি এই দিনটিতেই জন্মগ্রহণ করেছেন। অথচ কুরআন এবং হাদীসে নববীতে এর কোন দলীল পাওয়া যায় না।
ঘ. ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া রহ. সম্পর্কে বিরূপ ধারণা ও মন্তব্য
কারবালার মার্মান্তিক হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে একদল সাধারণ লোক এমনকি কিছু সংখ্যক আলেমও ইয়াযিদ ইবনে মুয়াবিয়া রহ. সম্পর্কে না জেনে বিরূপ ধারণা পোষণ করে থাকেন। তাকে কাফের, ফাসেক, জাহান্নামী এমনকি ফিরআউনের চেয়ে নিকৃষ্ট বলা হয়ে থাকে। সত্যিকথা হচ্ছে, সালফে সালেহীনের বক্তব্য ও আমলের মাধ্যমে এ ধরণের কোন বিষয়ে সমর্থন পাওয়া যায় নি। তাই এধরণের ভ্রান্ত আক্বীদা হতে আমাদের সুন্নাহ সমর্থিত সহীহ আক্বীদার দিকে ধাবিত হওয়া উচিত।
৭. আশুরা দিবসে বর্জণীয়
ক. শোক দিবস হিসেবে পালন করা
হুসাইন ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যু এই দিনে হয়েছিল বিধায় এই দিনটিকে শোকদিবস হিসেবে পালন করার রীতি শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
عن أم عطية عن النبي صلى الله عليه و سلم قالت : كنا ننهى أن نحد على ميت فوق ثلاث إلا على زوج أربعة أشهر وعشرا
অর্থঃ উম্মে আতিয়্যা রাদিয়াল্লাহু আনহা কর্তৃক বর্ণিত, মৃত ব্যক্তির জন্য আমাদেরকে তিনদিনের বেশী শোক করতে নিষেধ করা হয়েছে শুধুমাত্র স্বামী মারা গেলে স্ত্রীদের জন্য চার মাস দশদিন শোক পালন করতে হয়। (বুখারী: ৫৩৪১)
হুসাইন ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর মৃত্যু হয়েছে চৌদ্দশত বছর পূর্বে কাজেই এতবছর পরও শোক পালন করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ অমান্য করার নামান্তর।
খ. মাতম করা, আহাজারী করা, বুক চাপরানো, পোষাক ছিড়ে ফেলা প্রভৃতি
আশুরার দিবসে আমাদের দেশে বিশেষ কিছু স্থানে বেশ আয়োজন করে তাজিয়া মিছিল বের করা হয়। এই তাজিয়া মিছিলের নেপথ্যে থাকে শিয়া সম্প্রদায়। তারা মিছিলে বুক চাপরায়, বিলাপ করে, পোষাক ছিড়ে ফেলে, শরীর রক্তাক্ত করে হুসাইন ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর শোক প্রকাশ করে থাকে। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
عن عبد الله بن مسعود رضى الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : ليس منا من ضرب الخدود، وشق الجيوب، ودعا بدعوة الجاهلية. رواه البخاري ومسلم
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি গালের উপর চপেটাঘাত করল, বক্ষদেশ বিদির্ণ করল এবং জাহিলিয়াতের ডাকে র অনুসরণ করে আহবান করল সে আমাদের (মুসলমানদের) অন্তর্ভুক্ত নয়”। (বুখারী: ১২৩৬ ও মুসলিম: ২৯৬)
عن أم عطية رضى الله عنها قالت: أخذ علينا رسول الله صلى الله عليه وسلم عند البيعة أن لا ننوح. رواه البخاري ومسلم
উম্মে আতীয়্যা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত যে, রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বাইয়াত গ্রহণকালে আমাদের থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন যেন আমরা মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশার্থে উচ্চ শব্দে আনুষ্ঠানিকভাবে কান্নাকাটি না করি। (বুখারী: ১৩০৬ ও মুসলিম: )
عن أبي هريرة رضى الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم اثنان في الناس هما بهم كفر: الطعن في النسب، والنياحة على الميت. رواه مسلم
আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে, রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ “দুটি বিষয় এমন যা মানুষের মধ্যে কুফরী বলে গণ্য হয় ঃ বংশধারা কে কলংকিত করা ও মৃত ব্যক্তির জন্য শোক প্রকাশার্থে উচ্চ শব্দে কান্নাকাটি করা।” (মুসলিম: ১২১)
গ. এ দিনে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা এবং তার ফযিলত বর্ণনা করা
আশুরার দিবসে বিশেষ খাবারের আয়োজন করার বিশেষ ফযিলত সম্পর্কে একটি হাদীস বর্ণনা করা হয়।
হাদীসটি হচ্ছেঃ
من وسع على عياله يوم عاشوراء وسع الله عليه سائر السنة. قال الإمام أحمد : لا يصح هذا الحديث
“যে ব্যক্তি আশুরার দিনে তার পরিবারবর্গের লোকদের জন্য সচ্ছলতার (ভাল খাবার) ব্যবস্থা করবে আল্লাহ সারা বছর তাকে সচ্ছল রাখবেন।”
ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেন ঃ হাদীসটি সহীহ নয়।
ঘ. এ দিবসকে কবর যিয়ারতের জন্যে বিশেষভাবে নির্দিষ্ট করে নেয়া
ঙ. কারবালার ময়দানে উপস্থিত হয়ে মাতম ও তাযিয়া মিছিল করা
৮. আশুরার শিক্ষা
ক. হক ও বাতিলের চিরন্তন সংঘাতে হকের বিজয় নিশ্চিত এবং আল্লাহর সাহায্য হক পন্থীদের জন্য অবধারিত। এ বাস্তবতা আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে এবং বিশ্বাসে পরিণত করতে হবে। তাই আল্লাহ তা‘আলা বনী ইসরাঈলকে আশুরার এ দিবসে বিজয় দান করেছেন।
وَأَوْرَثْنَا الْقَوْمَ الَّذِينَ كَانُوا يُسْتَضْعَفُونَ مَشَارِقَ الأرْضِ وَمَغَارِبَهَا الَّتِي بَارَكْنَا فِيهَا وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ الْحُسْنَى عَلَى بَنِي إِسْرَائِيلَ بِمَا صَبَرُوا وَدَمَّرْنَا مَا كَانَ يَصْنَعُ فِرْعَوْنُ وَقَوْمُهُ وَمَا كَانُوا يَعْرِشُونَ
অর্থঃ আর যে জাতিকে দুর্বল মনে করা হত আমি তাদেরকে যমীনের পূর্ব ও তার পশ্চিমের উত্তরাধিকারী বানালাম, যেখানে আমি বরকত দিয়েছি এবং বনী ইসরাঈলের উপর তোমার রবের উত্তম বাণী পরিপূর্ণ হল। কারণ তারা ধৈর্য ধারণ করেছে। আর ধ্বংস করে দিলাম যা কিছু তৈরি করেছিল ফির‘আউন ও তার কওম এবং তারা যা নির্মাণ করেছিল। (সূরা আরাফঃ ১৩৭)
খ. আশুরা একটি গুরত্বপূর্ণ ইসলামী দিবস যাতে কেবল সিয়াম পালন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া এদিবসে অন্য কোন ধরণের আনুষ্ঠানিকতা বা ইবাদত পালনের শরয়ী বৈধতা ও মর্যাদা নেই। তাই এ দিবসকে বিশেষভাবে ঘটা করে পালন করার কোন প্রকারের দলীল দ্বারা সাব্যস্ত হয়নি।
গ. শুকরিয়া আদায় কেবল মৌখিক বিষয় নয়। শুকরিয়া আদায়ের একটি উপায় হচ্ছে, সিয়াম পালন। মুসা আলাইহিস্সালাম সিয়াম পালনের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার শুকরিয়া আদায় করেছেন। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ কাজটিকে হাদীসের মাধ্যমে সমর্থন করেছেন।
ঘ. আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় লাভ করার পর তার শুকরিয়া আদায় করতে হবে। অবনত চিত্তে, বিগলিত অন্তরে, সিজদানমিত মস্তকে তার অনুগ্রহ ও দয়ার কথা স্বীকার করে নিতে হবে। বিজয়ের আনন্দ-উল্লাস, হৈ চৈ ও বাড়াবাড়ি যেন আমাদেরকে আল্লাহর শুকরিয়া থেকে বিমুখ না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ঙ. কারবালার ইতিহাস স্মরণে আশুরা পালনের নামে যে সকল মাতম, মর্সিয়া,তাযিয়া মিছিল, শরীর রক্তাক্ত করাসহ যা কিছু করা হয় এর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। ইসলাম এ সকল কার্যকলাপের অনুমোদন দেয় না। এগুলো সন্দেহাতীত ভাবে বিদআত। এগুলো পরিহার করে চলা ও অন্যদের পরিহার করতে উৎসাহিত করা রসূলে কারীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সুন্নাহ অনুসারী সকল ঈমানদারের কর্তব্য।
মহান আল্লাহর নিকট দো‘আ করি যেন তিনি আমাদেরকে আশুরা সম্পর্কিত যাবতীয় বিদআত, কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা, বানোয়াট ভিত্তিহীন হাদীস বলা ইত্যাদি বর্জণ করে কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে আশুরাকে জানা ও এ দিবসের করণীয় কাজসমূহ করার ও বর্জণীয় বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করার তাওফিক দান করেন। মহান আল্লাহ আমাদের হক কথা বুঝার ও তা মেনে চলার তাওফিক দান করুন, আমীন।
(সুত্রঃ ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইনস্টিটিউট ফর এডুকেশন এন্ড রিসার্চ)
No comments:
Post a Comment